হারকিউলিস
মহাভারতে যেমন ভীম, গ্রীস দেশের পুরাণে তেমনই হারকিউলিস। হারকিউলিস
দেবরাজ জুপিটারের পুত্র কিন্তু তার মা এই পৃথিবীরই এক রাজকন্যা, সুতরাং
তিনিও ভীমের মত এই পৃথিবীরই মানুষ, গদাযুদ্ধে আর মল্লযুদ্ধে তাঁর সমান কেহ
নাই। মেজাজটি তাঁর ভীমের চাইতেও অনেকটা নরম, কিন্তু তাঁর এক একটি কীর্তি
এমনি অদ্ভুত যে, পড়িতে পড়িতে ভীম, অর্জুন, কৃষ্ণ আর হনুমান এই চার
মহাবীরের কথা মনে পড়ে।
হারকিউলিসের জন্মের সংবাদ যখন স্বর্গে পৌঁছিল, তখন তাঁর বিমাতা জুনো দেবী
হিংসায় জ্বলিয়া বলিলেন, “আমি এই ছেলের সর্বনাশ করিয়া ছাড়িব।” জুনোর
কথামত দুই প্রকান্ড বিষধর সাপ হারকিউলিসকে ধ্বংস করিতে চলিল। সাপ যখন শিশু
হারকিউলিসের ঘরে ঢুকিল, তখন তাহার ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখিয়া ঘরসুদ্ধ লোকে
ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া গেল, কেহ শিশুটিকে বাঁচাইবার জন্য চেষ্টা করিতে পারিল
না।
কিন্তু হারকিউলিস নিজেই তাঁর দুইখানি কচি হাত বাড়াইয়া সাপ দুটার
গলায় এমন চাপিয়া ধরিলেন যে, তাহাতেই তাদের প্রাণ বাহির হইয়া গেল। জুনো
বুঝিলেন, এ বড় সহজ শিশু নয়! বড় হইয়া হারকিউলিস সকল বীরের গুরু বৃদ্ধ
চীরনের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে গেলেন। চীরন জাতিতে সেন্টর—তিনি মানুষ নন।
সেন্টরদের কোমর পর্যন্ত মানুষের মত, তার নীচে একটা মাথাকাটা ঘোড়ার শরীর
বসান। চীরনের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়া হারকিউলিস অসাধারণ যোদ্ধা হইয়া
উঠিলেন। তখন তিনি ভাবিলেন, ‘এইবার পৃথিবীটাকে দেখিয়া লইব।’
হারকিউলিস পৃথিবীতে বীরের উপযুক্ত কাজ খুঁজিতে বাহির হইয়াছেন, এমন সময়
দুটি আশ্চর্য সুন্দর মূর্তি তাঁর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হারকিউলিস
দেখিলেন দুটি মেয়ে—তাদের একজন খুব চঞ্চল, সে নাকে-চোখে কথা কয়, তার
দেমাকের ছটায় আর অলঙ্কারের বাহারে যেন চোখ ঝলসাইয়া দেয়। সে বলিল,
“হারকিউলিস, আমাকে তুমি সহায় কর, আমি তোমায় ধন দিব, মান দিব, সুখে
স্বচ্ছন্দে আমোদের আহ্লাদে দিন কাটাইবার উপায় করিয়া দিব।”
আর একটি মেয়ে
শান্তশিষ্ট, সে বলিল, “আমি তোমাকে বড় বড় কাজ করিবার সুযোগ দিব, শক্তি
দিব, সাহস দিব। যেমন বীর তুমি তার উপযুক্ত জীবন তোমায় দিব।” হারকিউলিস
খানিক চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আমি ধন মান সুখ চাই না—আমি তোমার সঙ্গেই
চলিব। কিন্তু তোমার পরিচয় জানিতে চাই।” তখন দ্বিতীয় সুন্দরী বলিল, “আমার
নাম পুন্য। আজ হইতে আমি তোমার সহায় থাকিলাম।”
তারপর কত বৎসর হারকিউলিস দেশে দেশে কত পুন্য কাজ করিয়া ফিরিলেন—তাঁর গুণের
কথা আর বীরত্বের কথা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। থেবিসের রাজা ক্রয়ন্ তাঁর
সঙ্গে তাঁর কন্যা মেগারার বিবাহ দিলেন। হারকিউলিস নিজের পুন্য ফলে কয়েক
বৎসর সুখে কাটাইলেন।
কিন্তু বিমাতা জুনোর মনে হারকিউলিসের এই সুখ কাঁটার মত বিঁধিল। তিনি কী
চক্রান্ত করিলেন, তাহার ফলে একদিন হারকিউলিস হঠাৎ পাগল হইয়া তাঁর স্ত্রী
পুত্র সকলকে মারিয়া ফেলিলেন। তারপর যখন তাঁর মন সুস্থ হইল, যখন তিনি
বুঝিতে পারিলেন যে পাগল অবস্থায় কি সর্বনাশ করিয়াছেন, তখন শোকে অস্থির
হইয়া এক পাহাড়ের উপরে নির্জন বনে গিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন, ‘আর
বাঁচিয়া লাভ কি?’
হারকিউলিস দুঃখে বনবাসী হইয়াছেন, এদিকে জুনো ভাবিতেছেন, ‘একনও যথেষ্ট হয়
নাই।’ তিনি দেবতাদের কুমন্ত্রণা দিয়া এই ব্যবস্থা করাইলেন যে, এক বৎসর সে
আর্গসের দুর্দান্ত রাজা ইউরিসথিউসের দাসত্ব করিবে।
হারকিউলিস প্রথমে এই অন্যায় আদেশ পালন করিতে রাজী হন নাই—কিন্তু দেবতার
হুকুম লঙ্ঘন করিবার উপায় নাই দেখিয়া, শেষে তাহাতেই সম্মত হইলেন। রাজা
ইউরিসথিউস্ ভাবিলেন, এইবার হারকিউলিসকে হাতে পাওয়া গিয়াছে। ইহাকে দিয়া
এমন সব অদ্ভুত কাজ করাইয়া লইব, যাহাতে আমার নাম পৃথিবীতে অমর হইয়া
থাকিবে।
নেমিয়ার জঙ্গলে এক দুর্দান্ত সিংহ ছিল, তার দৌরাত্মে দেশের লোক অস্থির
হইয়া পড়িয়াছিল। রাজা ইউরিসথিউস্ বলিলেন, ‘যাও হারকিউলিস! সিংহটাকে
মারিয়া আইস।” হারকিউলিস সিংহ মারিতে চলিলেন। “কোথায় সেই সিংহ?” পথে যাকে
জিজ্ঞাসা করেন সেই বলে, “কেন বাপু সিংহের হাতে প্রাণ দিবে? সে সিংহকে কি
মানুষে মারিতে পারে?
আজ পর্যন্ত যে-কেহ সিংহ মারিতে গিয়াছে সে আর ফিরে
নাই।” কিন্তু হারকিউলিস ভয় পাইলেন না। তিনি একাকী গভীর বনে সিংহের গহ্বরে
ঢুকিয়া, সিংহের টুঁটি চাপিয়া তাহার প্রাণ বাহির করিয়া দিলেন। তারপর সেই
সিংহের চামড়া পরিয়া তিনি রাজার কাছে সংবাদ দিতে ফিরিলেন।
রাজা বলিলেন, “এবার যাও লের্নার জলাভুমিতে। সেখানে হাইড্রা নামে সাতমুণ্ড
সাপ আছে, তাহার ভয়ে লোকজন দেশ ছাড়িয়া পলাইতেছে। জন্তুটাকে না মারিলে ত
আর চলে না।” হারকিউলিস তৎক্ষণাৎ সাতমুণ্ড জানোয়ারের সন্ধানে বাহির হইলেন।
লের্নার জলাভুমিতে গিয়া আর সন্ধান করিতে হইল না, কারণ, হাইড্রা নিজেই ফোঁস
ফোঁস শব্দে আকাশ কাঁপাইয়া তাঁকে আক্রমণ করিতে আসিল। হারকিউলিস এক ঘায়ে
তার একটা মাথা উড়াইয়া দিলেন—কিন্তু, সে কি সর্বনেশে জানোয়ার—সে একটা
কাটা মাথার জায়গায় দেখিতে দেখিতে সাতটা নূতন মাথা গজাইয়া উঠিল।
হারকিউলিস দেখিলেন, এ জন্তু সহজে মরিবা নয়। তিনি তাঁহার সঙ্গী ইয়োলাসকে
বলিলেন, “একটা লোহা আগুনে রাঙাইয়া আন ত।”
তখন জ্বলন্ত গরম লোহা আনাইয়া
তারপর হাইড্রার এক একটা মাথা উড়াইয়া কাটা জায়গায় লোহার ছ্যাঁকা দিয়া
পোড়াইয়া দেওয়া হইল। কিন্তু এত করিয়াও নিস্তার নাই, শেষ একটা মাথা আর
কিছুতেই মরিতে চায় না—সাপের শরীর হইতে একেবারে আলগা হইয়াও সে সাংঘাতিক
হাঁ করিয়া কামড়াইতে আসে। হারকিউলিস তাহাকে পিটিয়া মাটিতে পুঁতিয়া,
তাহার উপর প্রকাণ্ড পাথর চাপা দিয়া তবে নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন। ফিরিবার
আগে হারকিউলিস সে সাপের রক্তে কতগুলা তীরের মুখ ডুবাইয়া লইলেন, কারণ,
তাঁহার গুরু চীরণ বলিয়াছেন—হাইড্রার রক্তমাখা তীর একেবারে অব্যর্থ
মৃত্যুবাণ।
হারকিউলিস ইউরিসথিউসের দেশে ফিরিয়া গেলে পর, কিছুদিন বাদেই আবার তাঁর ডাক
পড়িল। এবারে রাজা বলিলেন, “সেরিনিয়ার হরিণের কথা শুনিয়াছি, তার সোনার
শিং, লোহার পা, সে বাতাসের আগে ছুটিয়া চলে। সে হরিণ আমার চাই—তুমি তাহাকে
জীবন্ত ধরিয়া আন।”
হারকিউলিস আবার চলিলেন। কত দেশ দেশান্তর, কত নদী সমুদ্র
পার হইয়া, দিনের পর দিন সেই হরিণের পিছন ঘুরিয়া ঘুরিয়া, শেষে উত্তরের
ঠান্ডা দেশে বরফের মধ্যে হরিণ যখন শীতে অবশ হইয়া পড়িল, তখন হারকিউলিস
সেখান হইতে তাকে উদ্ধার করিয়া রাজার কাছে হাজির করিলেন।
ইহার পর রাজা হুকুম দিলেন, এরিম্যান্থাসের রাক্ষসবরাহকে মারিতে হইবে। সে
বরাহ খুবই ভীষ্ণ বটে, কিন্তু তাকে মারিতে হারকিউলিসের বিশেষ কোন ক্লেশ
হইবার কথা নয়। তা ছাড়া, বরাহ পলাইবার পাত্র নয়, সুতরাং তার জন্য দেশ
বিদেশ ছুটিবারও দরকার হয় না। হারকিউলিস সহজেই কার্যোদ্ধার করিতে পারিতেন,
কিন্তু মাঝ হইতে একদল হতভাগা সেন্টর আসিয়া তাঁর সহিত তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া
বসিল। হারকিউলিস তখন সেই হাইড্রার রক্ত-মাখান বিষবাণ ছুঁড়িয়া তাদের
মারিতে লাগিলেন।
এদিকে বৃদ্ধ চীরণের কাছে খবর গিয়াছে যে, হারকিউলিস নামে
কে একটা মানুষ আসিয়া সেন্টরদের মারিয়া শেষ করিল। চীরণ তখনই ঝগড়া
থামাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া দৌড়িয়া আসিতেছেন, এমন সময়, হঠাৎ করিয়া
হারকিউলিসের একটা তীর ছুটিয়া তাঁর গায়ে বিঁধিয়া গেল। সকলে হায় হায়
করিয়া উঠিল, হারকিউলিসও অস্ত্র ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন। সেন্টরেরা অনেকরকম
ঔষধ জানে, হারকিউলিসও তাঁর গুরুর কাছে অস্ত্রাঘাতের নানারকম চিকিৎসা
শিখিয়াছেন—কিন্তু সে বিষবাণ এমন সাংঘাতিক, তার কাছে কোন চিকিৎসাই খাটিল
না। চীরণ আর বাঁচিলেন না। এবার হারকিউলিস তাঁর কাজ সারিয়া, নিতান্ত বিষন্ন
মনে গুরুর কথা ভাবিতে ভাবিতে দেশে ফিরিলেন।
হারকিউলিস একা সেন্টরদের যুদ্ধে হারাইয়াছেন, এই সংবাদ চারিদিকে রাষ্ট্র
হইয়া পড়িল। সকলে বলিল, “হারকিউলিস না জানি কর বড় বীর! এমন আশ্চর্য
কীর্তির কথা আমরা আর শুনি নাই।” আসলে কিন্তু হারকিউলিসের বড় বড় কাজ এখনও
কিছুই করা হয় নাই—তাঁর কীর্তির পরিচয় সবেমাত্র আরম্ভ হইয়াছে।
বরাহ মারিয়া হারকিউলিস অল্পই বিশ্রাম করিবার সুযোগ পাইলেন—কারণ তারপরেই
এলিস নগরের রাজা আগিয়াসের গোয়ালঘর সাফ করিবার জন্য তাঁহার ডাক পড়িল।
আগিয়াসের প্রকান্ড গোয়ালঘরে অসংখ্য গরু, কিন্তু বহু বৎসর ধরিয়া সে ঘর
কেহ ঝাঁট দেয় না, ধোয় না—সুতরাং তাহার চেহারাটি তখন কেমন হইয়াছিল, তাহা
কল্পনা করিয়া দেখ।
গোয়ালঘরের অবস্থা দেখিয়া হারকিউলিস ভাবনায় পড়িলেন।
প্রকান্ড ঘর, তাহার ভিতর হাঁটিয়া দেখিতে গেলেই ঘণ্টাখানেক সময় যায়। সেই
ঘরের ভিতর হয়ত বিশ বৎসরের আবর্জনা জমিয়াছে—অথচ একজন মাত্র লোকে তাকে সাফ
করিবে। ঘরের কাছ দিয়া আলফিউস নদী স্রোতের জোরে প্রবল বেগে বহিয়া
চলিয়াছে—হারকিউলিস ভাবিলেন—’এই ত চমৎকার উপায় হাতের কাছেই রহিয়াছে!’
তিনি তখন একাই গাছ পাথরের বাঁধ বাঁধিয়া স্রোতের মুখ ফিরাইয়া, নদীটাকে সেই
গোয়ালঘরের উপর দিয়া চালাইয়া দিলেন। নদী হু হু শব্দে নূতন পথে বহিয়া
চলিল, বিশ বৎসরের জঞ্জাল মুহূর্তের মধ্যে ধুইয়া সাফ হইয়া গেল। তারপর
দেখানকার নদী সেখানে রাখিয়া তিনি দেশে ফিরিলেন।
এদিকে ক্রীটদ্বীপে আর এক বিপদ দেখা দিয়াছে। জলের দেবতা নেপচুন সে দেশের
রাজাকে এক প্রকান্ড ষাঁড় উপহার দিয়া বলিয়াছেন, “এই জন্তুটিকে তুমি
দেবতার নামে উৎসর্গ করিয়া বলি দাও।” কিন্তু ষাঁড়টি এমন সুন্দর যে, তাকে
বলি দিতে রাজার মন সরিল না—তিনি তার বদলে আর একটি ষাঁড় আনিয়া বলির কাজ
সারিলেন। নেপচুন সমুদ্রের নীচে থাকিয়াও এ সমস্তই জানিতে পারিলেন। তিনি
তাঁর ষাঁড়কে আদেশ দিলেন, “যাও! এই দুষ্ট রাজার রাজ্য ধ্বংস কারিয়া ইহার
অবাধ্যতার সাজা দাও।” নেপচুনের আদেশ সেই সর্বনেশে ষাঁড় পাগলের মত চারিদিকে
ছুটিয়া সারাটি রাজ্য উজাড় করিয়া ফিরিতেছে।
একে দেবতার ষাঁড়, তার উপর
যেমন পাহাড়ের মত দেহখানি, তেমনই আশ্চর্য তার শরীরের তেজ—কাজেই রাজ্যের লোক
প্রাণভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলাইবার জন্য ব্যস্ত। এমন জন্তুকে বাগাইবার জন্য ত
হারকিউলিসের ডাক পড়িবেই। হারকিউলিসও অতি সহজেই তাকে শিং ধরিয়া মাটিতে
আছড়াইয়া একেবারে পোঁটলা বাঁধিয়া রাজসভায় নিয়া হাজির করিলেন। রাজা
ইউরিসথিউসের মেয়ে বাপের বড় আদুরে। সে একদিন আবদার ধরিল তাকে হিপোলাইটের
চন্দ্রহার আনিয়া দিতে হইবে। হিপোলাইট এসেজন্দের রানী। এসেজন্দের দেশে
কেবল মেয়েদেরই রাজত্ব।
বড় সর্বনেশে মেয়ে তারা— সর্বদাই লড়াইয়ের জন্য
প্রস্তুত, পৃথিবীর কোন মানুষকে তারা ডরায় না। কিন্তু হারকিউলিসকে তারা খুব
খাতির সম্মান করিয়া তাদের রানীর কাছে লইয়া গেল। হারকিউলিস তখন রানীর
কাছে তার প্রার্থনা জানাইলেন। রানী বলিলেন, “আজ তুমি খাও-দাও, বিশ্রাম কর,
কাল অলঙ্কার লইতে আসিও।” হারকিউলিসের সৎমা জুনো দেবী দেখিলেন, নেহাৎ সহজেই
বুঝি এবারের কাজটা উদ্ধার হইয়া যায়। তিনি নিজে এসেজন্ সাজিয়া এসেজন্
দলে ঢুকিয়া, সকলকে কুমন্ত্রণা দিতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন, “এই যে লোকটি
রানীর কাছে অলঙ্কার ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে ইহাকে তোমরা বড় সহজ পাত্র মনে
করিও না।
আসলে কিন্তু এ লোকটা আমাদের রানীকে বন্দী করিয়া লইয়া যাইতে
চায়। অলঙ্কার-টলঙ্কার ওসকল মিথ্যা কথা—কেবল তোমাদের ভুলাইবার জন্য।” তখন
সকলে রুখিয়া একেবারে মার মার শব্দে হারকিউলিসকে আক্রমণ করিল। হারকিউলিস
একাকী গদা হাতে আত্মরক্ষা করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর এসেজন্রা
বুঝিল, হারকিউলিসের সঙ্গে পারিয়া উঠা তাহাদের সাধ্য নয়। তখন তাহারা রানীর
চন্দ্রহার হারকিউলিসকে দিয়া বলিল, “যে অলঙ্কার তুমি চাহিয়াছিলে, এই লও।
কিন্তু তুমি এদেশে আর থাকিতে পাইবে না।” হারকিউলিসের কাজ উদ্ধার হইয়াছে,
তাঁর আর থাকিবার দরকার কি? তিনি তখনই তাদের নমস্কার করিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
ইউরিসথিউস্ মহা সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “হারকিউলিস! আমি তোমার উপর বড়
সন্তুষ্ট হইলাম। তুমি আমার জন্য আটটি বড় কাজ করিলে, এখন আর চারিটি কাজ
করিলে তোমার ছুটি। প্রথম কাজ এই যে, স্টাইমফেলাসের সমুদ্রতীরে যে বড় বড়
লৌহমুখ পাখি আছে, সেগুলোকে মারিতে হইবে।” হারকিউলিস হাইড্রার রক্তমাখা
বিষাক্ত তীর ছুঁড়িয়া সহজেই পাখিগুলাকে মারিয়া শেষ করিলেন। ইহার পর তিনি
রাজার হুকুমে গেরিয়ানিস নামে এক দৈত্যের গোয়াল হইতে তার গরুর দল কাড়িয়া
আনিলেন। পথে ক্যাকাস্ নামে এক কদাকার দৈত্য কয়েকটা গরু চুরি করিবার
চেষ্টা করিয়াছিল। হারকিউলিস তাকে তার বাসা পর্যন্ত তাড়া করিয়া, শেষে
গদার বাড়িতে তাহার মাথা গুঁড়াইয়া দেন।
পশ্চিমের দেবতা সন্ধ্যাতারার মেয়েদের নামে হেস্পেরাইদিস্। লোকে বলিত,
তাদের বাগানে আপেল গাছে সোনার ফল ফলে। একদিন রাজা সেই ফল হারকিউলিসের কাছে
চাহিয়া বসিলেন। এমন কঠিন কাজ হারলিউলিস আর করেন নাই। ফলের কথা সকলেই জানে,
কিন্তু কোথায় যে সে ফল, আর কোথায় যে সে আশ্চর্য বাগান, কেউ তাহা বলিতে
পারে না। হারকিউলিস দেশ-বিদেশ ঘুরিয়া কেবলই জিজ্ঞাসা করিয়া ফিরিতে
লাগিলেন, কিন্ত কেউ তার জবাব দিতে পারে না। কত দেশের কত রকম লোকের সঙ্গে
তাঁর দেখা হইল, সকলেই বলে, “হাঁ, সেই ফলের কথা আমরাও শুনিয়াছি, কিন্তু
কোথায় সে বাগান তাহা জানি না।”
এই রূপে ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন হারকিউলিস এক
নদীর ধারে আসিয়া দেখিলেন, কয়েকটি মেয়ে বসিয়া ফুলের মালা গাঁথিতেছে।
হারকিউলিস বলিলেন, “ওগো, তোমরা হেস্পেরাইডিসের বাগানের কথা জান? সেই
যেখানে আপেল গাছে সোনার ফল ফলে?” মেয়েরা বলিল, “আমরা নদীর মেয়ে, নদীর জলে
থাকি—আমরা কি দুনিয়ার খবর রাখি? আসল খবর যদি চাও তবে বুড়ার কাছে যাও।”
হারকিউলিস বলিলেন, “কে বুড়া?
সে কোথায় থাকে?” মেয়েরা বলিল, “সমুদ্রের
থুড়্থুড়ে বুড়া, যার সবুজ রঙের জটা, যার গায়ে মাছের মত আঁশ, যার
হাত-পাগুলো হাঁসের মত চ্যাটাল— সে বুড়া যখন তীরে ওঠে তখন যদি তাকে ধরতে
পার, তবে সে তোমায় বলিতে পারিবে পৃথিবীর কোথায় কি আছে। কিন্তু খবরদার!
বুড়া বড় সেয়ানা, তাকে ধরিতে পারিলে খবরটা আদায় না করিয়া ছেড়ো না।”
হারকিউলিস তাদের অনেক ধন্যবার দিয়া বুড়ার খবর লইতে চলিলেন।
সমুদ্রের তীরে
তীরে খুঁজিতে খুঁজিতে একদিন হারকিউলিস দেখিলেন, শ্যাওলার মত পোশাক পরা কে
একজন সমুদ্রের ধারে ঘুমাইয়া রহিয়াছে। তাহার সবুজ চুল আর গায়ের আঁশেই তার
পরিচয় পাইয়া হারকিউলিস এক লাফে তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “বুড়া!
হেস্পেরাইডিসের বাগানের সন্ধান বল, নহিলে তোমায় ছাড়িব না।” এই বলিতে না
বলিতেই বুড়া তাঁর সামনেই কোথায় মিলাইয়া গেল, তার জায়গায় একটা হরিণ
কোথা হইতে আসিয়া দেখা দিল।
হারকিউলিস বুঝিলেন এসব বুড়ার শয়তানী, তাই
তিনি খুব মজবুত করিয়া হরিণের ঠ্যাং ধরিয়া থাকিলেন। হরিণটা তখন একটা পাখি
হইয়া করুণ স্বরে আর্তনাদ আর ছট্-ফট্ করিতে লাগিল। হারকিউলিস তবু
ছাড়িলেন না। তখন পাখিটা একটা তিন-মাথাওয়ালা কুকুরের রূপ ধরিয়া তাঁকে
কামড়াইতে আসিল। হারকিউলিস তখন থার ঠাংটা আরও শক্ত করিইয়া চাপিয়া ধরিলেন।
তাতে কুকুরটা চিৎকার করিয়া গেরিয়ানের মূর্তিতে দেখা দিল। গেরিয়ান
শরীরটা মানুষের মত, কিন্তু তার ছয়টি পা। এক পা হারকিউলিসের মুঠোর মধ্যে,
সেইটা ছাড়াইবার জন্য সে পাঁচ পায়ে লাথি ছুঁড়িতে লাগিল।
তাহাতেও ছাড়াইতে না পারিয়া সে প্রকান্ড অজগর সাজিয়া হারকিউলিসকে গিলিতে
আসিল। হারকিউলিস ততক্ষণে ভয়ানক চটিয়া গিয়াছেন, তিনি সাপটাকে এমন টুটি
চাপিয়া ধরিলেন যে, প্রাণের ভয়ে বুড়া তাহার নিজের মূর্তি ধরিয়া বাহির
হইল। বুড়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “তুমি কোথাকার অভদ্র হে! বুড়া মানুষের
সঙ্গে এরকম বেয়াদবি কর।” হারকিউলিস বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে, আগে আমার
প্রশ্নের জবাব দাও।”
বুড়া তখন বেগতিক দেখিয়া বলিল, “যার কাছে গেলে তোমার
কাজটি উদ্ধার হইবে, আমি তার সন্ধান বলিতে পারি। এইদিকে আফ্রিকার সমুদ্রতীর
ধরিয়া বরাবর চলিয়া যাও, তাহা হইলে তুমি এটলাস দৈত্যের দেখা পাইবে। এমন
দৈত্য আর দ্বিতীয় না। দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর সমস্ত আকাশটিকে ঘাড়ে
করিয়া সে ঠায় দাঁড়াইয়া আছে। এক মুহূর্ত তাহার কোথাও যাইবার যো নাই,
তাহা হইলে আকাশ ভাঙ্গিয়া পৃথিবীর উপর পাড়িবে।
মেঘের উপরে কোথায় আকাশ
পর্যন্ত তাহার মাথা উঠিয়া গিয়াছে, সেখান হইতে দুনিয়ার সবই সে দেখিতে
পায়। সে যদি খুশী মেজাজে থাকে, তবে হয়ত তোমার সোনার ফলের কথা বলিতে
পারে।” হারকিউলিস তাঁর গদা ঘুরাইয়া বলিলেন, “যদি খুশী মেজাজে না থাকে,
তবুও সোনার ফলের কথা তাকে বলাইয়া ছাড়িব।
সমুদ্রের বুড়ার কাছে এটলাসের
খবর আদায় করিয়া হারকিউলিস তাহার কথা মত আফ্রিকার উপকূল ধরিয়া পশ্চিম
মুখে চলিতে লাগিলেন। চলিতে চলিতে কত পাহাড় নদী, কত সহর গ্রাম পার হইয়া,
তিনি এক অদ্ভুত দেশে আসিলেন। সেখানে মানুষগুলো অসম্ভবরকম বেঁটে। শত্রুর ভয়
তাদের এতই বেশী যে, তাহাদের দেশ রক্ষার জন্য তারা এক দৈত্যের সঙ্গে
বন্ধুতা করিয়া, তারই উপর পাহারা দিবার ভার রাখিয়াছে। এই দৈত্যের নাম
এন্টিয়াস—পৃথিবী তার মা।
দূর হইতে হারলিউলিসকে গদা ঘুরাইয়া আসিতে দেখিয়া, বামনদের মধ্যে মহা হৈ-চৈ
বাধিয়া গেল। তারা চিৎকার করিয়া এন্টিয়াসকে সাবধান করিয়া দিল।
এন্টিয়াসও তাহাই চায়। তার ভয়ে বহুদিন পর্যন্ত লোকজন কেউ সে দিকে ঘেঁষে
না, তাই হারকিউলিসকে দেখিয়াই সে একেবারে গদা উঠাইয়া “মার্ মার্” করিয়া
তাঁহাকে আক্রমণ করিল।
হারকিউলিসও তৎক্ষণাৎ তার গদা এড়াইয়া, এক বাড়িতে
তাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! মাটিতে পড়িবামাত্র তার
তেজ যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল। সে আবার উঠিয়া ভীষণ তেজে হারকিউলিসকে
মারিতে উঠিল। হারকিউলিস আবার তাকে ঘাড়ে ধরিয়া মাটিতে পাড়িয়া ফেলিলেন,
কিন্তু মাটি ছোঁয়ামাত্র আবার তার অসম্ভব তেজ বাড়িয়া গেল, সে আবার
হুঙ্কার দিয়া লাফাইয়া উঠিল। হারকিউলিস ত জানে না যে পৃথিবীর বরে মাটি
ছুঁইলেই তাহার তেজ বাড়ে।
তিনি বার বার তাকে নানারকম মারপ্যাঁচ দিয়া
মাটিতে ফেলেন, বার বারই কোথা হইতে তার নূতন তেজ দেখা দেয়। তখন তিনি
দৈত্যটাকে ঘাড়ে ধরিয়া শূন্যে তুলিয়া দুই হাতে তাকে এমন চাপিয়া ধরিলেন
যে, সেই চাপের চোটে তার দম বাহির হইয়া প্রাণসুদ্ধ উড়িয়া গেল। তখন তার
দেহটাকে তিনি পাহাড় পর্বত ডিঙ্গাইয়া কোথায় ছুঁড়িয়া ফেলিলেন, তাহার আর
কোন খোঁজই পাওয়া গেল না।
তখন বামনেরা সবাই মিলিয়া ভয়ানক কোলাহল আর কান্নাকাটি জুড়িয়া দিল। কেহ,
“হায় হায়” করিয়া চুল ছিঁড়িতে লাগিল, কেহ প্রাণভয়ে ছুটাছুটি করিতে
লাগিল, কেহ আস্ফালন করিয়া বলিল, “এস, আমরা সকলে ইহার প্রতিশোধ লই।”
হারকিউলিস তাদের বলিলেন, “ভাইসকল, তোমাদের সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া নাই। ওই
হতভাগা খামখা আমাকে মারিতে আসিয়াছিল, তাই উহাকে যৎকিঞ্চিৎ সাজা দিয়াছি।
তোমাদের আমি কোন অনিষ্ট করিতে চাই না।” এই বলিয়া তিনি লম্বা লম্বা পা
ফেলিয়া, সেখান হইতে সেই সোনার আপেলের সন্ধানে এটলাস দৈত্যের খবর লাইতে
চলিলেন।
এই ভাবে পথ চলিতে চলিতে শেষে হারকিউলিস সত্য সত্যই এটলাসের দেখা পাইলেন।
সেই সমুদ্রের বুড়া যেমন বর্ণনা করিয়াছিল, ঠিক সেইরকমভাবে সেই বিরাট দৈত্য
আকাশটাকে মাথায় লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। হারকিউলিসকে দেখিয়া সে মেঘের
ডাকের মত গম্ভীর গলায় বলিল, “আমি এটলাস—আমি আকাশকে মাথা ধরিয়া রাখি—আমার
মত আর কেউ নাই।”
হারকিউলিস তাকে নমস্কার করিয়া বলিলেন, “আপনার সন্ধানে আমি
দেশ-বিদেশ ঘুরিয়াছি—এখন আমার একটি প্রশ্ন আছে, সেইটি জিজ্ঞাসা করিতে
চাই।” দৈত্য বলিল, “এই আকাশের নীচে মেঘের উপরে থাকিয়া আমার চোখ সব দেখে,
সব জানে—যাহা জানিতে চাও আমাকে জিজ্ঞাসা কর।” হারকিউলিস বলিলেন, “তবে
বলিয়া দিন, হেস্পেরাইডিসের বাগানে যে সোনার ফল ফলে, সেই ফল আমি কেমন
করিয়া পাইতে পারি।” দৈত্য হইলেও এটলাসের মেজাজটি বড় ভাল।
সে বলিল,
“তাহাতে আর মুশকিল কি? এই আকাশটাকে তুমি একটুক্ষণ ধরিয়া রাখ, আমি এখনই
তোমায় সেই ফল আনিয়া দিতেছি।” হারকিউলিস ভাবিলেন, “এ বড় চমৎকার কথা। কত
কীর্তি সঞ্চয় করিয়াছি, কিন্তু আকাশটাকে ঠেকাইয়া অক্ষয় কীর্তি রাখিবার
এমন সুযোগ আর কোনদিন পাইব না।” তাই তিনি দৈত্যের কথায় তৎক্ষণাৎ রাজী
হইলেন।
কত হাজার হাজার বছর এটলাসের ঘাড়ে আকাশের ভার চাপান রহিয়াছে, শীত গ্রীষ্ম,
রোদ বৃষ্টি সব সহিয়া বেচারা সেই বোঝা মাথায় রাখিয়া আসিতেছে। এতদিন পরে
হারকিউলিসের কৃপায় সে একটু জিরাইয়া লইবার সুযোগ পাইল। মনের আনন্দে সে খু
খানিকটা লাফাইয়া, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া, তারপর লম্বা পা ফেলিয়া চক্ষের
নিমেষে হেস্পেরাইডিসের বাগানে গিয়া হাজির।
সেখানে ‘ড্রেগন’ মারিয়া বাগান
খুঁজিয়া সোনার আপেল তুলিয়া আনিতে তার একটুও বিলম্ব হইল না। তখন তাহার
মনে হঠাৎ এক কুবুদ্ধি জাগিল। সে ভাবিল, কেন আর মিছামিছি আকাশের বোঝা লইয়া
থাকি। এই মানুষটার উপরেই এখন আকাশের ভার দিলেই হয়। এই ভাবিয়া সে
হারকিউলিসকে বলিল, “ওহে পৃথিবীর মানুষ, তোমার গায়ে ত বেশ শক্তি দেখিতেছি।
এখন হইতে তুমিই আকাশটাকে ঠেকাইবার ভার লও না কেন? আমি বরং তোমার রাজার কাছে
আপেলগুলা দিয়া আসি!”
হারকিউলিস দেখিলেন, বেগতিক! এ হতভাগা একটুক্ষণ ছুটি পাইয়া আর কাজে ফিরিতে
চায় না। তিনি একটু চালাকি করিয়া বলিলেন, “তবে ভাই একটু আকাশটাকে ধর ত,
আমার এই সিংহচর্মটিকে কাঁধের উপর ভাল করিয়া পাতিয়া লই।” বোকা দৈত্য
তাড়াতাড়ি ফলগুলা রাখিয়া, আবার নিজের কাঁধ দিয়া আকাশটাকে আগলইয়া ধরিল।
হারকিউলিসও তৎক্ষণাৎ ফলগুলা উঠাইয়া লইয়া, দৈত্যকে এক লম্বা নমস্কার দিয়া
সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন। দৈত্য বেচারা ব্যাপারটা কিছুই বুঝিতে না
পারিয়া, ফ্যাল্ফ্যাল্ করিয়া তাকাইয়া রহিল।
এত পরিশ্রম করিয়া সোনার ফল আনিয়াও হারকিউলিসের দাসত্ব ঘুচিল না। রাজা
ইউরিসথিউস্ বলিলেন, “আর একটি কাজ তোমায় করিতে হইবে—তুমি পাতালে গিয়া
যমের কুকুর সারবেরাস্কে বাঁধিয়া আন।” হারকিউলিস পাতালে গিয়া, সেই
ভীষণমূর্তি কুকুরকে ধরিয়া রাজার সম্মুখে হাজির করিলেন। তার তিন মাথায়
তিনটি মুখ, সেই মুখ দিয়া বিষ ঝরিয়া পড়িতেছে, নাকে চোখে আগুনের মত
ধোঁয়া— তার মূর্তি দেখিয়া ভয়ে রাজার প্রাণ উড়িবার উপক্রম হইল—তিনি একটা
জালার মধ্যে ঢুকিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন—”ওটাকে শীঘ্র সরাইয়া লও।”
হারকিউলিস তখন আবার যেখানকার কুকুর সেইখানে রাখিয়া আসিলেন।
এতদিনে হারকিউলিস তাঁর স্বাধীনতা ফিরিয়া পাইলেন। তখন তিনি নিজের ইচ্ছামত
ত্রিভুবন ঘুরিয়া আরও অদ্ভুত কাজ করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। কত বড় বড় যুদ্ধে
সাহায্য করিয়া, কত বীরত্বের কীর্তিতে যোগ দিয়া তিনি আপনার আশ্চর্য
শক্তির পরিচয় দিতে লাগিলেন। পাহাড় উপড়াইয়া জিব্রাল্টার প্রণালীর পথ
খুলিয়া তিনি সমুদ্রের সঙ্গে সমুদ্র জুড়িয়া দিলেন। সুন্দরী আলসেবিটস
নিজের প্রাণ দিয়া স্বামীকে অমর করিতে চাহিয়াছিলেন, হারকিউলিস যমের সহিত
যুদ্ধ করিয়া সেই আলসেবিটসকে মৃত্যুর গ্রাস হইতে কাড়িয়া আনিলেন।
এইরূপ ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন ঈনিয়ুসের সুন্দরী কন্যা ডেয়ানীরাকে দেখিয়া
হারকিউলিস তাকে বিবাহ করিতে চাহিলেন। কিন্তু, কোথা হইতে এক জলদেবতা আসিয়া
তাহাতে গোল বাধাইয়া দিল। সে বলিল, “ঈনিয়ুস আমাকে কন্যা দান করিবেন
বলিয়াছেন, তুমি কোথাকার কে যে মাঝ হইতে দাবী বসাইতে আসিয়াছ?”
তখন
ডেয়ানীরার অনুমতি লইয়া হারকিউলিস জলদেবতার সহির দ্বন্দযুদ্ধ বাধাইয়া
দিলেন। সে এই অদ্ভুত দেবতা, আপন ইচ্ছামত চেহারা বদলায়। প্রথমেই
হারকিউলিসের কাছে খুব খানিক চড়চাপড় খাইয়া, সে ষাঁড়ের মূর্তি ধরিয়া
তাঁকে গুঁতাইতে আসিল। হারকিউলিস তখন তার শিং ভাঙ্গিয়া দিলেন; সে পলাইয়া
আবার আর এক মূর্তিতে ফিরিয়া আসিল। এইরূপ বহুক্ষণ যুদ্ধের পর হারকিউলিস
তাকে এমন কাবু করিয়া ফেলিলেন যে, প্রাণের দায়ে সে দেশ ছাড়িয়া চম্পট
দিল।
তারপর হারকিউলিস ডেয়ানীরাকে বিবাহ করিয়া তাঁহার সঙ্গে দেশ ভ্রমণে বাহির
হইলেন। কত রাজ্য কত দেশ ঘুরিয়া, একদিন তাঁরা এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে আসিয়া
উপস্থিত হইলেন। নদীতে ভয়ানক স্রোত দেখিয়া হারকিউলিস ডেয়ানীরাকে পার
করিবার উপায় ভাবিতেছেন; এমন সময়ে নেসাস নামে এক বুড়া সেন্টর
(মানুষ-ঘোড়া) আসিয়া বলিল, “আমি এই মেয়েটিকে পিঠে করিয়া পার করিয়া
দিব।”
ডেয়ানীরা সেন্টরের পিঠে চড়িয়া নদী পার হইলেন, হারকিউলিসও একহাতে
তাঁহার তীর ধনুক জল হইতে উঠাইয়া, আর একহাতে ঢেউ ঠেলিয়া পার হইতে লাগিলেন।
নদীর ওপারে গিয়া হতভাগা নেসাস ভাবিল, “আহা! এমন সুন্দরী মেয়ে কেন এই
মানুষটার সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ায়? তাহার চাইতে ইহাকে লইয়া আমাদের দেশে
পলাইয়া যাই না?” এই ভাবিয়া সে ডেয়ানীরাকে লইয়া এক ছুট্ দিল।
ডেয়ানীরার চিৎকারে হারকিউলিস মাথা তুলিয়া চাহিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ জলের
ভিতর হইতে তীর ছুঁড়িয়া নেসাসের মর্মভেদ করিয়া ফেলিলেন। মরিবার সময়
দুষ্ট সেন্টর অত্যন্ত ভাল মানুষের মত অনেক আনুতাপ করিয়া ডেয়ানীরাকে
বলিয়া গেল, “আমার ঘাড়ের উপর হইতে এই জামাটি খুলিয়া তুমি রাখিয়া দাও।
যদি তোমার স্বামীর ভালবাসা কোনদিন কমিতে দেখ, তবে এই জামা তাহাকে পরাইলেই
তার সমস্ত ভালবাসা আবার ফিরিয়া আসিবে।” ডেয়ানীরা তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়া
জামাটি পরম যত্নে লুকাইয়া রাখিলেন। ততক্ষণে হারকিউলিসও নদী পার হইয়া
আসিয়াছেন, দুইজনে আবার চলিতে লাগিলেন।
তারপর কত বৎসর কাটিয়া গেল। একদিন কি একটা কাজের জন্য দূর দেশের এক
রাজসভায় হারকিউলিসের যাওয়া দরকার হইল। তিনি ডেয়ানীরাকে রাখিয়া সেই যে
বাহির হইলেন, তারপর কত দিন গেল, কত মাস গেল, হারকিউলিস আর ফিরিলেন না।
ডেয়ানীরা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “তবে কি হারকিউলিস আমায়
ভুলিয়া গেলেন?
আর কি তিনি আমায় ভালবাসেন না?” তিনি দূত পাঠাইলেন, তারা
আসিয়া বলিল, “হারকিউলিস বেশ ভালই আছেন—রাজসভায় নানা আমোদ-প্রমোদে তাঁর
দিন কাটিতেছে।” শুনিয়া ডেয়ানীরা সেই সেন্টরের দেওয়া জামাটি বাহির
করিলেন। সোনার মত ঝক্ঝকে জামা, সেন্টরের মৃত্যু সময়ে রক্তে ভিজিয়া
গিয়াছিল—কিন্তু এখন তাহাতে রক্তের চিহ্নমাত্র নাই। সেই জামা তিনি লাইকাস
নামে এক দূতকে দিয়া হারকিউলিসের কাছে পাঠাইয়া দিলেন— ভাবিলেন তাহা হইলে
হারকিউলিসকে শীঘ্র ফিরিয়া পাইবেন।
জামার কাহিনী ত হারকিউলিস জানেন না,
সেন্টরের রক্তে যে তাহা বিষাক্ত হইয়া আছে, এরূপ সন্দেহঈ তাঁর মনে জাগিল
না, তিনি নিশ্চিন্ত মনে সেই জামা পরিলেন। জামা পরিবামাত্র তাঁর সর্বাঙ্গ
জ্বলিতে লাগিল, তাঁর শিরায় শিরায় যেন আগুনের প্রবাহ ছুটিতে লাগিল। তিনি
তাড়াতাড়ি জামা ছাড়াইতে গিয়া দেখেন যে সর্বনাশ, জামা তাঁহার শরীরের
মধ্যে বসিয়া গিয়াছে; গায়ের চামড়া উঠিয়া আসে, তবু জামা ছাড়িতে চায়
না।
রাগে ও যন্ত্রণায় পাগল হইয়া তিনি দূতকে ধরিয়া সমুদ্রে ছুঁড়িয়া
ফেলিলেন। তারপর সেন্টরের বিষ এড়াইবার উপায় নাই দেখিয়া তিনি তার অনুচরদের
ডাকিয়া বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র কাঠ আন, আগুন জ্বাল, আমি এখন মরিতে ইচ্ছা
করি।” শুনিয়া সকলে কাঁদিতে লাগিল, কেহ চিতা জ্বালাইতে প্রস্তুত হইল না।
তখন তিনি আপন হাতে গাছ উপ্ড়াইয়া প্রকাণ্ড চিতা জ্বালাইয়া তাহাতে শুইলেন
এবং তাঁর এক বন্ধুকে বলিলেন, “তুমি যদি আমার বন্ধু হও, তবে আমার কথা
শুনিয়া এই চিতায় আগুন দাও। বন্ধুতার পুরস্কারস্বরূপ আমার বিষমাখান
অব্যর্থ তীরগুলি তোমায় দিলাম।”
তারপর চিতায় আগুন দেওয়া হইল, দেবতারা জয়গান করিয়া তাঁহাকে স্বর্গের
দেবতাদের মধ্যে ডাকিয়া লইলেন, এবং তাঁহাকে অমর করিয়া আকাশের নক্ষত্রদের
মধ্যে রাখিয়া দিলেন।