উচ্চমাধ্যমিক বাংলা – আমার বাংলা (সুভাষ মুখোপাধ্যায়) পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থ প্রশ্ন ও উত্তর

 রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর |

  1. ‘ দাফার কথা মনে পড়ে- দাফার কথা কখন মনে পড়ে ? দাফার পরিচয় দাও । 

Ans: দাফা হলো এক অজ্ঞাত কুলশীল ব্যক্তি । মৈমনসিংহ অঞ্চলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে তার পরিচয় ললিতেরর বাড়িতে । ছেলেবেলায় দাফা ছিল গোরু চোর ।

  লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ‘ আমার বাংলা ‘ গ্রন্থে অজ্ঞাত পরিচয় এব ব্যক্তি দাফার পরিচয় দিয়েছেন । ছোটবেলায় সে গোরু চুরি করত । তাতে ধরা পড়ার পর প্রায়শই কপালে জুটতো অমানবিক প্রহার । ফলে সারাগায়ে তার সেই চিহ্ন লেগে থাকত । ললিত তাকে পথ থেকে তুলে এনে গোরুর রাখালির কাজে লাগায় । প্রথমে একটু সে হাবাগোবা ধরনের ছিল , ক্রমে সে পড়াশোনা শিখল , এক কমিউনিষ্ট পার্টির সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হলো । একটা সময় সমিতির প্রচার , পার্টির কাজ , হাটে হ্যান্ডবিল বিলি করা , মিটিং এ চোঙা ফোঁকা সব কাজে দাফা সক্রিয় ছিল । 

  এই সহজ সরল দাফা সারাজীবন গ্রামে কাটিয়েছে । কখনও শহর দেখেনি তাই শহরে যাওয়ার বড়ো সাধ ছিল । তবে এই সাধ অপূর্ণই থেকে গিয়েছে । দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল দাফা তারই শিকার । মৃত্যুর পূর্বেও সে প্রবল লড়াই করেছিল । কিন্তু খালি হাতে বন্ধুকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরাজিত দাফা বুকে গুলি লেগে মৃত্যুবরণ করে । 

  1. গারো পাহাড়ের নীচে য ারা বাস করে তাদের জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ।

Ans: গারো পাহাড়ের নীচে বিভিন্ন জাতি অধিবাসীর বসবাস । তাদের মধ্যে রয়েছে গারো , হাজং , ডালু , কোচ , বানাই , মার্গান প্রভৃতি উপজাতি । তারা সকলেই প্রায় নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে মঙ্গোলীয় ধাঁচের , কেন – না তাদের চোখে – মুখে পাহাড়ি ছাপ । আর তারা সকলেই পাহাড়ি জমিতে কঠোর পরিশ্রমে চাষআবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে । এদের মধ্যে গারোরা প্রত্যেকেই মাচার উপর ঘর বেঁধে বাস করে । রান্নাবান্না – খাওয়া শোয়া সবই সেই মাচার উপর । এটা আসলে তাদের পাহাড়ি স্বভাব । পাহাড়ি জানোয়ারের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যই তাদের এমন উচ্চাসনে বাস । 

  হাজংরাই নাকি এই অঞ্চলের সংখ্যাগুরু অধিবাসী । তারাই নাকি এখানে প্রথম এসে পাহাড়ি জঙ্গল হাসিল করে , আবাদ করে এবং স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে । হাজরো চাষআবাদে দারুণ দক্ষ । প্রথমাবস্থায় চাষের কাজে তাদের কোনো জুড়ি ছিল না বলে অন্যেরা তাদের নাম দিয়েছিল ‘ হাজং ’ ‘ হাজং ’ শব্দের অর্থ পোকা । চাষে দক্ষ বা চাষের পোকা বলেই তাদের এমন নামকরণ । যদিও এখানকার অধিবাসীরা পর্যাপ্ত ফসল ফলালে ও জমিদারের অত্যাচারে এবং মহাজনী শোষণে চাষের ফসল তারা ঘরে তুলতে পারে না বলে তাদের মুখেচোখে অশান্তির একটা কালো ছায়া লক্ষ করা যায় । 

  1. “ কিন্তু হাতি – বেগার আর চলল না । ” — হাতি – বেগার আইন কী ? তা আর চলল না কেন ? অথবা , “ পঞ্চাশ – ষাট বছর আগে এ অঞ্চলে জমিদারি একটা আইন ছিল । ” — এখানে কোন আইনের কথা বলা হয়েছে ? এই আইনের পরিচয় দাও । 

Ans: ‘ আমার বাংলা ‘ গ্রন্থের ‘ গারো পাহাড়ের নীচে ‘ রচনাংশে ‘ হাতি – বেগার’আইনের প্রসঙ্গ আছে । এটি একটি জমিদারি আইন , যা গারো পাহাড়ে উনিশ শতকের শেষে আরম্ভ হয় । জমিদার হাতে অস্ত্র নিয়ে গারো পাহারের ওপর মাচা বেঁধে সেপাই – সান্ত্রিদের নিয়ে হাতি শিকার করার জন্য বসে থাকতেন । জমিদার আপদ – বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এই আইন প্রচলন করেছিলেন । উক্ত আইনানুসারে ছেলে – বুড়ো সহ গ্রামের সকল পুরুষ প্রজাকে জঙ্গলে উপস্থিত হতে হতো এবং যে জঙ্গলে হাতি থাকত সে জঙ্গলকে ঘিরে রাখার জন্য তাদের সারি সারি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো । কিন্তু একাজের বিনিময়ে প্রজাদের কোনো খাবার দেওয়া হতো না । প্রজাদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় সাপের বাঘের কামড়ে অনেককেই মরতে হতো । 

  জমিদারের বিলাসবহুল এই জঘন্য আইন প্রজারা মেনে নিতে পারেনি । গারো পাহাড়িরা গোরাচঁাদ মাস্টারের নেতৃত্বে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মিটিং করে । প্রজারা এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মিটিং করে এবং কামারশালায় অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করে । বিদ্রোহী প্রজারা জমিদারকে পরাজিত করতে না পারলেও জমিদার এই আইন চালু রাখতে সাহস পাননি । এভাবেই ‘ হাতি – বেগার ‘ আইনের অবসান ঘটে ।

  1. “ তাই প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠল । ” — প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল কেন ? কে তাদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ? 

Ans: প্রজারা জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ ছিল এই যে পঞ্চাশ – ষাট বছর আগে গারো পাহাড়ের নীচে জনপদে একটা আইন ছিল , তাকে বলা হতো হাতিবেগার । জমিদারের বেজায় শখ ছিল হাতি ধরার । সেজন্য জমিদার পাহাড়ে মাচা বাঁধিয়ে নিরিবিলিতে সেপাই সাস্ত্রী নিয়ে বসতেন । কোনো ত্রুটি যাতে না হয় তারা যে জঙ্গলে হাতি থাকত তা বেড় দিয়ে দাঁড়াতে । ছেলে – বুড়ো কারোর ছাড় ছিল কড়াকড়ি ব্যবস্থা ছিল । প্রতিটি গাঁ থেকে প্রজারা চাল – চিড়ে বেঁধে আসতে বাধ্য হে হতো । জমিদারের ওই অত্যাচার মানুষ কতদিন সহ্য করবে । প্রজারা তাই বিদ্রোহী হ হাতি বেড় দেওয়ার সময় কাউকে সাপের দংশনে কাউকে বাঘের মুখে প্রাণ নিয়ে উঠেছিল । তাদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোরচঁাদ মাস্টার নামে এক ব্যক্তি ।

  1. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ কলের কলকাতা রচনা অবলম্বন করে লেখকের জেলখানা ভ্রমণের বর্ণনা দাও । অথবা , “ চেয়ারের উপর যিনি বসে আছেন , তাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না- চেয়ারের উপর কে বসেছিলেন ? লেখক তাকে কোথায় দেখেছিলেন ? লেখকের স্থান দেখার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে লেখো । অথবা , “ ইংরেজের জেলখানায় হেঁট হয়ে ঢুকতে যা রাগ হচ্ছিল ” — লেখকের জেলখানার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বিবরণ দাও । 

Ans: ব্রিটিশ পুলিশের হাতে বন্দি রামদুলালবাবুকে দেখতে জেলখানায় গিয়েছিলেন । বালক লেখক । রামদুলালবাবুর দাদার সঙ্গে লেখক ট্রামে চড়ে পৌছান জেলের সিংহদুয়ারে । কিছুক্ষণ পর তাঁরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পান । মাথা নীচু করে জেলে ঢুকতে হয় বলে ক্ষুদ্ধ হন তিনি । লেখকদের পর পরই জেলখানায় পৌঁছায় একটি কয়েদিভ্যান । ভ্যানে থাকা স্বাধীনতার সেনানী ঐ কয়েদিদের ‘ বন্দেমাতরম ‘ স্লোগানে কেঁপে ওঠে জেলখানা । কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করার ঘরটিতে পৌঁছে লেখক দেখেন সেখানে বসে রয়েছেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । একটি মাত্র চেয়ার – টেবিলে সুভাষচন্দ্র বসে থাকলেও শতরঞ্জি পাতা ঘরের মধ্যে অগণিত মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল । একের পর এক কয়েদিভ্যান আসছে । সুভাষচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে নবাগতদের জড়িয়ে ধরে বলছেন , “ তোমরা এসেছ ? ” 

  জেল ওয়ার্ডারদের নজর এড়িয়ে ভেতরের বন্দিরা মাঝে মাঝে এসে ভিড় করেছিল জালের জানালায় । সিপাহিরা দেখামাত্রই তারা দৌড়ে পালিয়েও যাচ্ছিল । এমনই এক কয়েদি “ শোনো খোকা ” বলে লেখককে ডাকে । নিজের বাড়ির ঠিকানা ও নম্বর জানিয়ে ঐ কয়েদি তার ভালো থাকার খবর বৃদ্ধা মাকে পৌছে দিতে বলে । কিন্তু তার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়নি লেখকের । বাইরে বেরিয়ে এসে লেখকের মনে হয় যে রাস্তায় আন্দোলনরত মানুষগুলি জেলের অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে , এর প্রতিদানে তারা কী পাবে ? এসব ভাবতে ভাবতে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন । আর তখন মায়ের মুখে শোনা গান— “ ও তোর শিকল পরা ছল । শিকল পরে শিকলরে তুই করবি যে বিকল ” গাইতে গাইতে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন তিনি । প্রসঙ্গত , বালকের কৌতূহলবশত জেলের কয়েদিদের ও জেলখানার পরিবেশ দেখার সুযোগ পেয়ে লেখক যেমন আপ্লুত হয়েছিলেন , তাদের দুর্দশাও তাকে যথেষ্ট ব্যথিত করেছিল ।

  1. “ তোমরা হাত বাড়াও , তাকে সাহায্য করো । ” — লেখক কাকে , কীভাবে , কেন সাহায্য করতে বলেছেন ? 

Ans: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় মাজা পড়ে যাওয়া , হাটতে অক্ষম বারো – তেরো বছরের উলঙ্গ ছেলেটিকে , যে জানোয়ারের মতো চার পায়ে চলে , তাকে সাহায্য করতে বলেছেন । 

  লেখক ওই মাজাভাঙা ছেলেটিকে কীভাবে সাহায্য করা হবে তা – ও বলেছেন । ছেলেটি দু’হাত প্রসারিত ক’রে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চায় । সে দাঁড়ানোর জন্য তৎপর ও সচেষ্ট । তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করা হোক । 

  অবশ্য ওই ছেলেটি প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘ পরাধীন ও যুদ্ধ – দুর্ভিক্ষের অভিঘাতে ন্যূব্জপৃষ্ঠ বাঙালি জাতির প্রতীক । বাঙালি এখন মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় , তাকে হাত ধরে উচ্চশির হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা হোক । ওই ছেলেটির জ্বলজ্বলে দীপ্ত দু’চোখে শান্তির প্রত্যাশা । সে চায় মাঠের সোনালি ফসলে , চাষির গোলাভরা ধানে শান্তি । সে চায় কলকারখানায় শ্রমিকদের আন্দোলিত মিলিত বাহুতে শাস্তি । সে চায় আর দুর্ভিক্ষ নয় , আর যুদ্ধ নয় , স্বাধীন সুখী জীবন ও পরম শাস্তি । সে জন্য তাকে সাহায্য করা হোক । 

  1. সরু লিকলিকে আঙ্গুল দিয়ে সেই সব খুনীদের সে শনাক্ত করেছে . … .. … .. ” – কেশনাক্ত করেছে ? কাদের কেন ‘ খুনী ’ বলা হয়েছে ?

Ans: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ আমার বাংলা ‘ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘ হাত বাড়াও ‘ রচনায় রাজবাড়ির বাজারে বারো – তেরো বছরের মাজা পড়ে যাওয়া শীর্ণকায় যে ছেলেটিকে লেখক দেখেছিলেন তাকে উদ্দেশ্য করেই মন্তব্যটি করা হয়েছে । 

  ফরিদপুরে ট্রেন ধরার জন্য এক কুয়াশায় মোড়া সকালে রাজবাড়ির বাজারে বসেছিলেন লেখক । সেই সময় দূর থেকে চারপায়ে প্রায় জতুর মতো ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন শীর্ণকায় ছেলেটিকে । সে হাঁটতে অক্ষম , জানোয়ারের মতো বাজারে রাস্তায় খুঁটে খুঁটে চাল আর ছোলা খায় । অসহনীয় এই দৃশ্য দেখে ছুটে স্টেশনে পালিয়ে গেলেও তার জ্বলন্ত চোখ লেখকের জীবনকে তাড়া করে বেড়ায় । শুধু তাই নয় , লেখক সোনা ছড়ানো নদীমালার দিকে তাকিয়ে তার নিঃশ্বাস শুনতে পান । লেখকের মনে হয় সরু লিকলিকে আঙ্গুল দিয়ে সে সেইসব খুনিদের শনাক্ত করছে যারা শহরে , গ্রামে , বন্দরে জীবনকে হত্যা করছে , মানুষের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে । যারা সমাজের শ্রমের মূল্য দেয় না , যারা মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে হত্যা করছে তাদেরকে সে শনাক্ত করেছে খুনী বলে ।